ফেব্রুয়ারিতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ধরে ভোটের মাঠ সাজাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। গেলো ৩ নভেম্বর সংসদীয় ৩০০ আসনের ২৩৭টিতে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। যদিও পরে একটি স্থগিত করা হয়। কিছু আসন জোট শরিক বা মিত্রদের জন্য রেখে দিয়েছে তারা।
এদিকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পরই বিভিন্ন আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকেরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নবঞ্চিতদের আন্দোলন-বিক্ষোভ আর মিত্রদের আসন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে অনেকটা চাপের মধ্যে রয়েছে বিএনপি। এই চাপ কীভাবে সামাল দেবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বিএনপি ২৩৬টি আসনে নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা করলেও মিত্রদের জন্য কোন কোন আসন ছাড়বে, সেই বোঝাপড়ার খাতা এখনও খুলতে বাকি। ফলে ছোট ও মাঝারি দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের অনিশ্চয়তা।
সমঝোতার দড়ি টানাটানি
বিএনপির সূত্র বলছে, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে শরিকদের আসন-সমঝোতার কাজ চলছিল। কিন্তু তেমন গতি না থাকায় সেই দায়িত্ব সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর হাতে। দুজনই এখন সরাসরি শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন, প্রত্যেক দলকে আলাদাভাবে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন:
ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই তফসিল, ভোটগ্রহণের ৬০ দিন আগে ঘোষণা
এই মুহূর্তে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেখছি না, আমি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী
অর্ধশতাধিক আসনে বিদ্রোহের শঙ্কায় বিএনপি
কিন্তু শরিকদের দীর্ঘ চাহিদার তালিকার সামনে বিএনপির নেতাদের মুখেও চিন্তার ভাঁজ। প্রত্যাশা আর বাস্তবতার ফারাক যে এতটা, সেটাই এখন মূল সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য।
শরিকদের লম্বা তালিকা, চাহিদা ২৪৪ আসন!
পাঁচ দল ও দুই জোট মিলে বিএনপির কাছে এখন মোট ১০৬ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাবিত ১৩৮ আসন। সব মিলিয়ে শরিকদের দাবি ২৪৪ আসন। কিন্তু বিএনপি নিজেই ২৩৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ যে অল্প কিছু আসন খালি, সেখান থেকেই আবার মিত্রদের মন রাখতে হবে। সেকারণে প্রশ্ন উঠছে এতটা চাপ বিএনপি কতটা সামলাতে পারবে?

নতুন পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল
বিএনপি নেতাদের মতে, আসন ছাড়ার সিদ্ধান্তে এবার আগের চেয়ে দ্বিগুণ কৌশলগত হতে হবে। কারণ শরিকদের খুশি করতে গিয়ে ভুল জায়গায় আসন ছাড়লে শেষ পর্যন্ত নিজ দলের সম্ভাবনাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার ওপর নির্বাচনি লড়াইয়ে জামায়াত এবার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এগোচ্ছে।
‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনা পাওয়া ছয় নেতা
বিএনপির নেতৃত্বে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছয় নেতাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট আসনে দায়িত্ব দিয়ে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এ চিঠিতে সংশ্লিষ্ট আসনের থানা, উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপি নেতাকর্মীদের জোটভুক্ত প্রার্থীদের সহায়তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চিঠি পাওয়া নেতাদের মধ্যে আছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব (লক্ষ্মীপুর-৪), নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-২), গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি (ঢাকা-১২), গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর (পটুয়াখালী-৩) ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন (ঝিনাইদহ-২) এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা (কিশোরগঞ্জ-৫)।
আরও পড়ুন:
মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়ন স্থগিত করলো বিএনপি
বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাকে মনোনয়ন, পরিবর্তনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ
মনোনয়ন না পাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ-অগ্নিসংযোগ
এছাড়া চিঠির বাইরে ১২ দলীয় জোটের নেতা ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে প্রচারণা চালানো ও সাংগঠনিক কাজ করতে বলা হয়েছে।

জোটের ভেতরে এ সিদ্ধান্তকে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হলেও বিএনপির কিছু দায়িত্বশীল নেতা এটিকে মাঠপর্যায় শক্তিশালী নির্বাচনি সমন্বয়ের অংশ হিসেবেই দেখছেন।
এদিকে, বিএনপির অনেকে বলছেন, ঢাকা-৮ আসনে মির্জা আব্বাসের সক্রিয়তা এবং প্রচারে সাইফুল হকের সম্ভাবনা কমে গেছে। ফলে শরিকদের মধ্যে প্রশ্ন, তাহলে কি আন্দোলনের দিনগুলোতে আমাদের গুরুত্ব ছিল আর এখন ভোটে এসে মূল্যায়ন কমে গেলো?
ছোট দলগুলোর বড় কৌশল
জানা গেছে, শরিকদের অনেকেই বড় তালিকা পাঠিয়েছে দলের ভেতরের নেতাদের খুশি রাখার কৌশল হিসেবে। তারা জানেন, মনোনয়ন পাবেন মাত্র এক থেকে দুইজন। কিন্তু তালিকায় নাম থাকলে নেতাকর্মীদের কাছে ওই ব্যক্তি ‘প্রধান প্রার্থী’ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পান। এক অর্থে এটি ‘দল বাঁচানোর’ কৌশল। মনোনয়ন না পেলেও বাইরে প্রচার থাকে, দল ভাঙনের ঝুঁকিও কমে।
২০১৮ থেকে ২০২৫, হিসাব বদলে গেছে
২০১৮ সালের নির্বাচনে শরিকদের ৫৮টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে ২২টি পেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের ফলে ২০২৫ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আন্দোলনে একসঙ্গে থাকলেও নির্বাচনে জামায়াত এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে আগের মতো আসন ছাড়তে পারছে না বিএনপি।
শরিকদের হতাশা ও চাপ
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বক্তব্যে হতাশার সুর লক্ষ্য করা গেছে। মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রচারণায় বিলম্ব তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
বিএনপির জোটসঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসন এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আরও দুই দফা বৈঠকের মধ্যে বিষয়টি সমাধান হবে বলে আশা করছি। তবে আমরা প্রচারণায় পিছিয়ে পড়েছি।’
ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আগেভাগে মনোনয়ন হলে ভালো হয়। দেরি হলে আমাদের নেতাকর্মীরা মাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।’

এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম আরও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মাঠের প্রার্থীদের বর্তমানে অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিটি দিন যেন একটা বছর, সত্যিই দমবন্ধ পরিস্থিতি।’
আরও পড়ুন:
তফসিলের আগে দেশে না ফিরলে ভোটার হতে পারবেন না তারেক রহমান
ঢাকা এখন ‘পোস্টার-ব্যানারের নগরী’
‘বহিষ্কৃতদের ওপর আস্থা’ রেখেই নির্বাচনি মাঠে বিএনপি
জোটসংশ্লিষ্ট একাধিক নেতা মনে করছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হলে মাঠপর্যায়ে সমন্বয়, সাংগঠনিক প্রস্তুতি এবং ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কৌশল ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গণধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কবে আলোচনা হবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা পিছিয়ে-এগিয়ে এসব ভাবছি না; আমাদের নিজস্ব দল আছে।’
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও ঐক্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আবার মিত্রদেরও সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি।
আসন বণ্টন নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কাজ চলছে। শিগগির সিদ্ধান্ত জানা যাবে।’
কেএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএস
from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/nQvBsI5
via IFTTT