মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা, ডাকটিকিট, ধাতব ও কাগজি মুদ্রা নিয়ে সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান দীর্ঘ ৩৭ বছরে গবেষণা করেছেন। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটেনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ফেলো নির্বাচিত করে। ১৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ১৩০টি বই।
জন্ম যশোর শহরের খড়কি এলাকায় হলেও সিদ্দিকের স্কুল জীবন কেটেছে কলকাতায়। বাবা ফজলুর রহমান ছিলেন কলকাতায় পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের ভিসা বিভাগের কর্মকর্তা। যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরে বিএ পাস করেন। ১৯৮০ সালে সিদ্দিকুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন। কর্মজীবন সিদ্দিকুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কেটেছে। কখনো ওষুধ কোম্পানি, কখনো ডায়বেটিক সমিতি। প্রায় তিন বছর তিনি বাংলাদেশ মনিটর, ঢাকা কলিং ইংরেজি সাময়িকীর সহকারি সম্পাদক ছিলেন। এরপরে ২০১৯-২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগে ছুটিকালীন শূন্য পদে কিছুকাল শিক্ষকতাও করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই সিদ্দিকের লেখালেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা যা মনে আসতো তাই লিখতেন। অনেক লেখা জমা হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি লুট হলে লেখাগুলোও হারিয়ে যায়। ডাক ব্যবস্থা নিয়ে তার লেখালেখির শুরু ১৯৮৭ সালে। কয়েকজন বিদেশি বন্ধুর অনুরোধে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ডাকব্যবস্থা নিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এরপর ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তার একটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
এক সময় শখ ছিল ডাকটিকিট সংগ্রহ করার। মুক্তিযুদ্ধের পর বিদেশের গবেষকরা বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা সর্ম্পকে জানতে চায়। তখন সিদ্দিক তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এভাবে উত্তর দিতে গিয়ে তিনি অনেক কিছু জানতে পারেন। এদিকে সমানে বই প্রকাশ হতে থাকে। এক এক করে বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা, ডাকটিকিট, ধাতব ও কাগজি মুদ্রাব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে তার ৩০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটেনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ফেলো নির্বাচিত করে।
গেল ৩৭ বছরে বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা, ডাকটিকিট, ধাতব ও কাগজি মুদ্রা নিয়ে ৩০টি গবেষণা করেছেন। তার আগে দেশের ডাক ব্যবস্থা, ডাকটিকিট, আধুনিক ধাতব ও কাগজ মুদ্রার ইতিহাস নিয়ে এত বেশি গবেষণা আর কেউ করেছেন বলে জানা যায় না। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গবেষণা হলো, বাংলাদেশ স্টার্ম্প অ্যান্ড পোস্টাল হিস্টোরি, ১৯৮৮; বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা, ১৯৯৫; কড়ি টু টাকা-এভুলেশন অব কয়েনস অ্যান্ড কারেনসিস অব বাংলাদেশ, ২০১১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ডাকব্যবস্থা ও ডাকটিকিট, ২০১২; শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু, ডাকটিকেট, ধাতব ও কাগজি মুদ্রায়, ২০২১; কড়ি থেকে টাকা, বাংলাদেশের ধাতব ও কাগজি মুদ্রার বিবর্তন, ২০২২; বাংলাদেশের ডাকব্যবস্থা, ২০২৩ ইত্যাদি।
তবে এই গবেষণা করতে গিয়ে নানান বাধার সম্মুখীন হয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। বিশেষ করে কটুক্তি জুতেছে অনেক। গবেষণা কর্মে ভাত হয় নাকি? টাকা আয় হয়? সন্মান দিয়ে কি হবে। এমন কথা বলেছে অনেকে। ডাকটিকিট ও ডাকব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা একদমই ভালো চোখে দেখেননি ঘনিষ্ট আত্মীয়, বন্ধু বান্ধব। অবহেলা, অপমানের শিকার হয়েছেন। তবুও দমে যাননি। গবেষণা কর্ম চালিয়ে গেছেন। তথ্য, ছবি দিয়ে অনেকেই সাহায্য করেছে। এদের মধ্যে মধ্যে আব্দুস সালাম বি কম, সাঈদ বিন সালাম, ইকবাল মজিদের কাছে সিদ্দিকের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
অসংখ্য গবেষণা করলেও ডাক, মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্দিকের সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা তেমন নেই। না থাকার পেছনে তার এক বুক অভিমান রয়েছে। নব্বই দশকে যখন ডাকটিকিট নিয়ে লেখা দিতেন। সংবাদপত্রগুলো সেভাবে তা ছাপতো না। এ কারণে মন খারাপ করে আর কখনো কোনো সংবাদপত্রে তিনি লেখা পাঠাননি। ডাকব্যবস্থা ও ডাকটিকিট নিয়ে লেখা ছেপে তা মানুষদের মধ্যে বিলি করতেন। যাতে তারা এর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এমনই কিছু লেখা বাংলাপিডিয়ার একজন গবেষক প্রফেসর মুহিবুল্লাহ ও তার স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারপারসন শিরিণ আখতার এর চোখে পড়ে। তারা সিদ্দিককে ডেকে এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সদস্য করে নেন। বাংলাপিডিয়ার প্রধান সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম কাছেও তার ডাক পড়ে। বাংলাপিডিয়ার জন্য তিনি অনেকগুলো লেখা লিখে দেন। নিজে লাভবান না হলেও পকেটের টাকা খরচ করে সিদ্দিক অনেক বই প্রকাশ করেছেন যেন মানুষ ডাক, মুদ্রা ব্যবস্থা সর্ম্পকে জানতে পারে। সঠিক তথ্যটা সবাই জানুক। এমনটাই চেয়েছেন তিনি আজীবন।
তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি ডাকটিকিট সংগ্রহ করেছিলেন সিদ্দিক। তার কাছে ভারত, জার্মানির টিকিটও ছিল। কিন্তু যখন মাত্র ২৫ বছর বয়সে একামাত্র ছেলে ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করে, সিদ্দিক এই শোকে এতটাই ভেঙে পড়েন। জমানো শত শত ডাকটিবিকটের সংগ্রহ, খাম, চিঠি আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। এর আগে কিছু ডাক টিকিট বিক্রি করেছিলেন। ভাগনীর বিয়েতে গহনা ও বরের স্যুট ও ঘড়ি কেনার জন্য।
সিদ্দিকের লেখা একাধিক গ্রন্থ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ডাকব্যবস্থা বিষয়ক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। গবেষণার জন্য ১৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- লার্জ সিলভার মেডেল অ্যাওয়ার্ড ফর বাঙ্গালি পার্সোনালিটিস অন বাংলাদেশ পোস্টেজ স্ট্যাম্পস ১৯৭১-২০২৩, পেশয়ার পাকিস্তান ২০২৪ সিলভার মেডেল অ্যাওয়ার্ড ফর বাংলাদেশ পোস্টেজ স্ট্যাম্পস, ক্যাটালগ ১৯৭১-২০২৩, সিলভার মেডেল অ্যাওয়ার্ড ফর বাঙ্গালি পার্সোনালিটিস অন বাংলাদেশ পোস্টেজ স্ট্যাম্পস ১৯৭১-২০২৩, সারজাহ ২০২৩।
আগামী দিনে কি করবেন বা করবেন না, তা নিয়ে একদমই ভাবছেন না সিদ্দিক। যেভাবে চলছে চলুক সেভাবে। তবে নতুন লেখকদের জন্য তার কিছু পরামর্শ রয়েছে যেগুলো হলো কেবল কবিতা লেখাতে মনোনিবেশ না করে, ভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা উচিত। সিদ্দিক মাহমুদুর রহমানের গবেষণামূলক বই ৩০টি, অনুবাদ ৬৪ টি বাকিগুলো সাহিত্যের বই ও প্রাতিষ্ঠানিক বই অন্যান্য। তার জনপ্রিয় কয়েকটি সাহিত্য গ্রন্থ হচ্ছে- নাই কিরে সুখ, আর একটু সময়, সে আমার গোপন কথা, সায়েম মাহমুদের নিষ্ফল দ্বৈরথ, জিপসি জীবন-কোলকাতা ও কোলকাতা।
আরও পড়ুন
লেখক: এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সেলস অপারেশনস, ফেয়ার ডিষ্টিবিউশন লিমিটেড, খাজা পস্নাজা
কেএসকে/এমএস
from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/lBQoi8K
via IFTTT