রাশিয়ার প্রাচীনতম জামে মসজিদ

মওলবি আশরাফ

রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের দারবন্দ শহরের পুরনো অংশে দাঁড়িয়ে আছে একটি জামে মসজিদ—উত্তর এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ। অষ্টম শতকে ইরানিদের হাতে নির্মিত এ মসজিদ শুধু প্রাচীন স্থাপত্যই নয়, মুসলিম সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে আজও অক্ষত রয়েছে। ২০০৩ সালে ইউনেসকো the Old Derbent-কে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, যার অন্যতম প্রধান স্থাপনা এই জামে মসজিদ।

দারবন্দ শহরের ইতিহাস

এক সময় ‘দারবন্দ’ ছিল ইরানের অংশ। ফারসি দুটো শব্দ ‘দার’ ও ‘বন্দ’ মিলে এই নামের উৎপত্তি, যার অর্থ বন্ধ দরজা। কারণ, এই শহরটি বন্ধ দরজার মতোই ককেশাস অঞ্চলের পথে বাধা হয়ে আছে। ২২ হিজরিতে (৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে), খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) আমলে একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে এই শহরটি খেলাফতের অধীনে আসে। এরপর শহরটি খেলাফতের সামরিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে, বিশেষ করে খাজারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আশেপাশের অঞ্চল শাসনের জন্য। পাশাপাশি এটি হয়ে ওঠে বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র, বন্দর এবং ইসলামি দাওয়াত প্রচারের অন্যতম কেন্দ্র। এ কারণে অনেক আরব ইতিহাসবিদ শহরটিকে ‘বাবুল আবওয়াব’ বা সব দরজার দরজা বলে উল্লেখ করেন। আব্বাসি আমলের প্রথম দিকে দারবন্দ শিয়াপ্রধান হয়ে ওঠে, এই সময় শহরের প্রতিটি মহল্লায় ছোট ছোট অনেক মসজিদ নির্মিত হয়।

রাশিয়ার প্রাচীনতম জামে মসজিদ

দারবন্দ মসজিদ। ছবি: উইকিপিডিয়া

জামে মসজিদের ইতিহাস

অবশেষে ১১৫ হিজরিতে (৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে) সাধারণ মুসল্লিদের জন্য একটি বড় জুমার মসজিদ গড়ে তোলা হয়—এটিই আজকের জামে দারবন্দের প্রথম ভিত্তি। নির্মাণকালে এটি ছিল শহরের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। এরপর যুগে যুগে মসজিদতিতে বিভিন্ন সংস্কার আনা হয়। ১৩৬৮–৬৯ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বাকুর তাজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৮১৫ সালে এর সম্প্রসারণ ও পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে।

১৯৩০-এর দশকে সোভিয়েত আমলের ধর্মবিরোধী অভিযানের সময় মসজিদটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এটি শহরের কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে মস্কোর নির্দেশে আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে মসজিদটি ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং পুনরায় নামাজ শুরু হয়। দীর্ঘ সময় এটি উত্তর ককেশাসের সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল, এমন কি দক্ষিণ দাগেস্তানের একমাত্র জুমার মসজিদ হিসেবেও পরিচিত ছিল।

মাদরাসা ও ধর্মীয় কার্যক্রম

১৪৭৪–৭৫ সালের দিকে এখানে মাদরাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা পরে ১৮১৫ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। সোভিয়েত যুগে মসজিদের জন্য একটি সনদ তৈরি হয় এবং স্থানীয় মুসল্লিরা ২০ সদস্যের একটি পরিচালনা বোর্ড নির্বাচিত করেন। দারবন্দ শহরের সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ইমামের ব্যবস্থা আজও বিদ্যমান।

রাশিয়ার প্রাচীনতম জামে মসজিদ

দারবন্দ মসজিদ। ছবি: উইকিপিডিয়া

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

দারবন্দের জামে মসজিদ শুধু একটি নামাজঘর নয়, বরং এক বিস্তৃত স্থাপত্য কমপ্লেক্স। এর ভেতরে রয়েছে মূল মসজিদ, একটি মাদরাসা এবং আলেমদের আবাসস্থল। পশ্চিম থেকে পূর্বে দৈর্ঘ্য ৬৮ মিটার এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রস্থ ২৮ মিটার। গম্বুজের উচ্চতা ১৭ মিটার, যা দূর থেকেই চোখে পড়ে।

ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়—মসজিদটি তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রতিটি অংশকে আলাদা করেছে চতুষ্কোণ স্তম্ভ, যেগুলোর মাথায় সূক্ষ্ম নকশার ক্যাপিটাল বসানো। মাঝের অংশটি ৬.৩ মিটার চওড়া, আর দু’পাশের অংশ ৪ মিটার প্রশস্ত। স্তম্ভগুলোর মাঝখানে টানা হয়েছে ল্যানসেট ধাঁচের খিলান, যা অভ্যন্তরীণ স্থাপত্যে এক প্রকার গাম্ভীর্য ও ছন্দ সৃষ্টি করেছে।

মসজিদের আঙিনা ৫৫ বাই ৪৫ মিটার আয়তনের বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। এর সৌন্দর্যের বিশেষ চিহ্ন হলো চারটি প্রাচীন প্লেন গাছ, যেগুলো দারবন্দ শহরের যে কোনো জায়গা থেকে এই মসজিদকে চিনিয়ে দেয়। ২০১২ সালে এই গাছগুলোকে ‘natural monuments of all-Russian significance’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং রুশ ফেডারেশনের ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ফেডারেশন কাউন্সিলের অধীনে সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া হয়।

বর্তমান অবস্থা

২০১৫ সালে দারবন্দ শহরের ২০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মসজিদের ব্যাপক সংস্কার করা হয়। আজও এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে ইসলামি ঐতিহ্য ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্নি-শিয়া উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে একসাথে নামাজ আদায় করেন যা রাশিয়ার মুসলিম সমাজের ঐতিহাসিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ওএফএফ/এমএস



from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/nPbLAB8
via IFTTT
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post