সার তুলছেন না ডিলার, সংকটে কৃষক

একদিকে ডিলারদের অনীহায় সরকারি গুদামে পড়ে রয়েছে সার। অপরদিকে সংকটে পড়ে খুচরা দোকান থেকে বেশি দামে সার কিনছেন চাষিরা। যা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে কৃষকদের মধ্যে।

চলতি আউশ মৌসুমে সার সংকটে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গার কৃষকরা। অধিকাংশ ডিলার পয়েন্টে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সার পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ একই সময় খুচরা দোকানে দ্বিগুণ দামে সেই সার সহজলভ্য।

কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে সার না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দাম দিয়ে খুচরা দোকান থেকে সার সংগ্রহ করছেন। তাদের মতে, একটি সংগঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।

তবে অনেক ডিলার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের ছত্রছায়ায় ছিলেন কিংবা নেতা ছিলেন। যারা নিজেরাই ব্যবসা অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। যার ফলে তাদের নামে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন হচ্ছে না। ফলে সরকারি গোডাউনে সার মজুত বাড়ছে, আর কৃষক পর্যায়ে সারের সংকট দেখা দিচ্ছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

সার তুলছেন না ডিলার, সংকটে কৃষক

চুয়াডাঙ্গা সদর, জীবননগর, দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন মাঠে সরেজমিনে দেখা গেছে, ধান, পাট, পেঁপে ও আগাম শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত কৃষকরা প্রয়োজনীয় সারের অভাবে বিপাকে পড়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণ সার মিললেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ইউরিয়া সার ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ২৫ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ২৭ টাকা, টিএসপি সার ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ২৫ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২৭ টাকা, এমওপি সার ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৮ টাকা, কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২০ টাকা, ডিএপি সার ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৯ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২১ টাকা। কিন্তু উল্লিখিত মূল্যে সার বিক্রির কথা থাকলেও সংকটে দাম বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।

সদর উপজেলার পীরপুর গ্রামের চাষি মিনারুল ইসলাম জানান, ডিলারের কাছে কার্ড দেখালে বিঘা প্রতি মাত্র ১০ কেজি সার দিচ্ছে। আমার ৬ বিঘা জমির জন্য দরকার ১৮০ কেজি, অথচ পেয়েছি মাত্র ৬০ কেজি। বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে।

দামুড়হুদার ইব্রাহিমপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদের ভাষায়, প্রতি মৌসুমে একই সমস্যা। সময় মতো সার না পেলে চাষ করবো কীভাবে? এটা পরিকল্পিত সংকট। সিন্ডিকেট ছাড়া সম্ভব নয়।

তবে খুচরা বিক্রেতাদের মতে, জেলার বাইরে থেকে সার এনে বিক্রি করায় কিছুটা দাম বেশি পড়ছে।

নাম না জানিয়ে ভালাইপুর বাজারের একজন খুচরা বিক্রেতা জানান, চাহিদা মেটাতে বাইরে থেকে আনছেন, এজন্য ৯৫০ টাকার ইউরিয়া ২৩০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

সার তুলছেন না ডিলার, সংকটে কৃষক

একই বাজারের খুচরা সার ব্যবসায়ী আলমগীর হাসান বলেন, কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে জেলার বাইরের উৎস থেকে সার এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে দাম কিছুটা বাড়তি। এতে করে কৃষকদেরও বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে।

এদিকে সরকারি তথ্য বলছে জেলায় কোনো সার সংকট নেই। তবে বাস্তবতা ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৯৪ হাজার ২০ হেক্টর। বিসিআইসির অনুমোদিত ডিলার রয়েছেন ৫০ জন। বিএডিসির অনুমোদিত ডিলার রয়েছেন ৯৩ জন। চলতি মৌসুমে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার টন।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। শুধু জুলাই মাসে ইউরিয়া বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৭১৩ টন, কিন্তু উত্তোলন হয়েছে মাত্র ৯৬০ টন, মজুত আছে ২,৫৯৪ টন। টিএসপি বরাদ্দ ছিল ১,২৮৯ টন, মজুত ৪১৩ টন। ডিএপি বরাদ্দ ছিল ২,১৮৪ টন, মজুত ৮৬১ টন, এমওপি সারের বরাদ্দ ছিল ১,০৫৫ টন, তোলার পর মজুত রয়েছে ১,২৯৮ টন।

আলমডাঙ্গায় এনামুল হক নামের এক বিসিআইসি ডিলার বলেন, আমাদের এখানে সার সংকট নেই। তবে জেলার অনেক জায়গায় সংকট আছে শুনেছি। অনেক ডিলার ঠিকমতো সার উত্তোলন না করায় সরকারিভাবে মজুত বেশি থাকতে পারে।

সদর উপজেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিসিআইসির ডিলার বলেন, সার সরবরাহ কিছুটা কম, আবার সব কৃষক একসঙ্গে নিতে চাচ্ছেন। তাই সবাইকে কম করে দিতে হচ্ছে।

অপর এক ডিলারের ম্যানেজার বলেন, আমার যিনি ডিলার তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির আত্মীয় ও নিজেও আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তিনি বেশি সার উত্তোলন করেন না।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার জানান, সরকার নির্ধারিত ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করছে। কেউ গোপনে মজুত করলে বা দাম বাড়ালে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম বলেন, সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোন গুদামে সার যাচ্ছে, কে কী পরিমাণ নিচ্ছে, সেটা মনিটরিং করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, তামাক চাষিরা সরকারি সারের আওতায় নয়। সেক্ষেত্রে তালিকা তৈরি করে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। মাছ চাষিদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নিতে হবে।

এফএ/এমএস



from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/nx2zuvO
via IFTTT
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post