সম্ভাবনা-সীমাবদ্ধতার সমন্বয় করতে পারলেই সফলতা আসবে

মো. সাইদুর রহমান। গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।

সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় জুলাই আহতদের চিকিৎসা, চিকিৎসকদের পদোন্নতি, হাসপাতালগুলোতে প্রবীণ সেবা চালুসহ নানান বিষয়ে। জানিয়েছেন মানুষের জন্য সহজে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পরিকল্পনা। তিনি মনে করেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলেই আসবে সফলতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সচিব আপনি। জুলাই আহতদের জন্য কী করলেন?

স্বাস্থ্য সচিব: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের হাসপাতালগুলো যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো কাজ করেছে। বিশেষ করে ওই সময়ে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) জুলাই আহতদের সেবায় নেতৃত্ব দিয়েছে। এখনো হাসপাতালগুলো তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দিচ্ছে। যে ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন মনে হয়েছে, সে ক্ষেত্রে দেশের বাইরে তথা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এখনো সে প্রক্রিয়া চলমান।

আমাদের প্রবীণ রোগী ক্রমাগত বাড়ছে। তারা হয়তো মেডিসিন, কার্ডিয়াক বা অন্য ওয়ার্ডে আছে। বার্ধক্যের কারণে তার অতিরিক্ত কিছু সমস্যা আছে, যেটা সবার সঙ্গে সেবা নিতে গিয়ে আরও ক্ষতি হতে পারে।

স্বাস্থ্য সচিব হওয়ার আগেও জুলাই আহতদের নিয়ে আপনার উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েছে, কেন, কোন প্রেক্ষাপটে কাজ করেছিলেন?

স্বাস্থ্য সচিব: ওই সময়ে আমি এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক ছিলাম। আমি দেখলাম, আমাদের অপারেশন প্রয়োজন এমন রোগীর যে সংখ্যা, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সেই ক্যাপাসিটি নেই। অথচ সেখানে এনজিও ব্যুরোর কাজ করার সুযোগ আছে। তাই, তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর লিংকআপ করার চেষ্টা করলাম। বিশেষ করে, চক্ষু রোগীদের অপারেশনের জন্য ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতল, আল নুর ও আল মক্কা চক্ষু হাসপাতালের সহযোগিতা চাই। ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতাল বড় একটা সংখ্যক অপারেশন করে দেয়। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও কিছু অপারেশন করে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) জুলাই আহতদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্মীদের নানান সময় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর পাই। এরা তো মূলত হাত-পা হারা। মানসিক অবস্থাও চরম ক্ষতিগ্রস্ত। এসব রোগীর জন্য আপনাদের উদ্যোগ কী ছিল?

স্বাস্থ্য সচিব: দ্বন্দ্ব শব্দটা আমি বলবো না। সেবাগ্রহীতা কাঙ্ক্ষিত সেবা চায়। কোনো কোনো জায়গায় ব্যত্যয় হলে বা গ্যাপ হলে অসন্তোষ থাকতে পারে। সেগুলো নির্ণয় করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। যার হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, পা ফেলে দিতে হয়েছে, তার মধ্যে তো হতাশা ভর করবেই। আমরা চেষ্টা করেছি সেটা যাতে কাটিয়ে ওঠা যায়।

৩৭ হাজার চিকিৎসকের যে শূন্যপদ, এগুলোতে চিকিৎসকদের পদোন্নতির সুযোগ ছিল না। এজন্য সরকার সাত হাজার সুপার নিউমারারি পদ সৃজন করে সব যোগ্য চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংখ্যাটা বড় হওয়ায় আমাদের একটু সময় লাগছে

এখানে ব্র্যাক, সিআরপি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাকে আমরা যুক্ত করেছি। ব্রিজিংটা করে দিয়েছি। নিটোর থেকে একটা রোগী তার চিকিৎসা শেষ হলে কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা থেরাপি দেওয়ার কাজটা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন যার অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, তাকে নিটোর থেকে ব্র্যাক সরাসরি রিসিভ করেছে। নিয়ে গিয়ে থাকা-খাওয়া, মানসিক উন্নয়নে সপোর্ট দেওয়া এবং কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও ট্রেনিং তারা দিয়েছে। একইভাবে সিআরপি ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রও থেরাপির জন্য সরাসরি নিয়ে গিয়ে সেবা দিয়েছে। যার জন্য হয়রানিটা লাঘব করা গেছে।

সম্ভাবনা-সীমাবদ্ধতার সমন্বয় করতে পারলেই সফলতা আসবে

আপনার নতুন একটা উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, দেশের সব হাসপাতালে প্রবীণদের সেবার জন্য আলাদা জেরিয়াট্রিক কেয়ার ইউনিট করতে চান। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিই রোগীর চাপ কিন্তু জনবল ও উপকরণ সীমিত। নতুন এ ইউনিট কি নতুন চাপ তৈরি করবে না?

স্বাস্থ্য সচিব: না। মোটেও নতুন চাপ তৈরি করবে না। কারণ নতুন রোগী তো আসবে না। এখন যেসব রোগী আসছে তাদের মধ্যেই প্রবীণরা আছেন। আমাদের প্রবীণ রোগী ক্রমাগত বাড়ছে। তারা হয়তো মেডিসিন, কার্ডিয়াক বা অন্য ওয়ার্ডে আছে। বার্ধক্যের কারণে তার অতিরিক্ত কিছু সমস্যা আছে, যেটা সবার সঙ্গে সেবা নিতে গিয়ে আরও ক্ষতি হতে পারে। পড়ে গিয়ে কোমর বা হাঁটুতে ব্যথা পেতে পারে। তাদের আলাদা করে সেবাটা দেওয়ার জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। এজন্য রোগীর চাপও বাড়বে না। আলাদা করে জনবল বা উপকরণও লাগবে না। বরং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলেই তাদের একটু কেয়ার দেওয়া যায়। এটা মনে রাখলেই কাজটা সহজ- আমিও তো বৃদ্ধ হবো।

আপনি তো স্বাস্থ্যের অভিভাবক পর্যায়ে আছেন। যেভাবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি দেখবেন, একইভাবে সেবাদাতা চিকিৎসকদের অধিকারও দেখতে হয়। তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা বা ক্ষোভ আছে পদোন্নতি নিয়ে। এটার কী করছেন?

স্বাস্থ্য সচিব: পদোন্নতির কষ্ট চিকিৎসকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের। এটা সমাধানের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ৩৭ হাজার চিকিৎসকের যে শূন্যপদ, এগুলোতে চিকিৎসকদের পদোন্নতির সুযোগ ছিল না। এজন্য সরকার সাত হাজার সুপার নিউমারারি পদ সৃজন করে সব যোগ্য চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংখ্যাটা বড় হওয়ায় আমাদের একটু সময় লাগছে। আমরা হয়তো কাঙ্ক্ষিত সময়ে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সমাপ্ত করতে পারিনি। এখন খুব দ্রুতই কাজ হচ্ছে, ইনশাআল্লাহ শিগগির পদোন্নতি কার্যক্রম শেষ করতে পারবো।

সম্ভাবনা-সীমাবদ্ধতার সমন্বয় করতে পারলেই সফলতা আসবে

স্বাস্থ্য সেক্টর নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? কী কী করে যেতে চান?

স্বাস্থ্য সচিব: মূল পরিকল্পনা তো স্বাস্থ্যসেবা সহজে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো। আমাদের অনেকের টাকা আছে, সেবা চায়। আবার অনেকের টাকা নেই, সেবা চায়। উভয়ের জন্য সহজ ও মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করাই প্রধান কাজ। আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। তবে সম্ভাবনাও কম নয়। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে পারলেই সফলতা আসবে। অনেক হতাশার মধ্যেও আশার দিক হচ্ছে, আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের কাজ বিশ্ব স্বীকৃত। বেশ কয়েকবারই আমরা দেখেছি, আমাদের হাসপাতালগুলো যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, সেটাকে বেস্ট বলছে বিশ্বের বিখ্যাত হাসপাতালের চিকিৎসকরাও।

বিশেষ করে, জুলাই আহতদের চিকিৎসার জন্য সাত দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম আনা হয়েছে। আবার বিভিন্ন দেশেও পাঠানো হয়েছে রোগীদের। বিভিন্ন দেশের প্রথিতযশা চিকিৎসকরা আমাদের দেশের চিকিৎসকদের চিকিৎসাকে সঠিক ও যথার্থ বলেছেন। তবে, সেবা দিতে গিয়ে জনসংখ্যাধিক্যসহ নানান কারণে কিছু ব্যত্যয় হয়। মানুষের প্রত্যাশা অনেক সময় নিশ্চিত করা যায় না। আমরা সেগুলো অ্যাড্রেস করতে পারলেই মানুষ সন্তুষ্ট হবে, আশা করি।

এসইউজে/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম



from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/avE6ifz
via IFTTT
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post