মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের বাসিন্দা বিষ্ণু হাজরা পেশায় একজন চা শ্রমিক। ঝালমুড়ি বিক্রি করে বাড়তি রোজগার হলেও দারিদ্র্যের ছাপ তার সংসারে। কিন্তু গত ২৮ বছর ধরে তিনি এক ব্যতিক্রমী স্বপ্ন লালন করছেন—সবুজের স্বপ্ন। সুযোগ পেলেই নিজের বাইসাইকেলের পেছনে চারা ও সরঞ্জাম নিয়ে ছুট লাগান তিনি। দীর্ঘ এই সময়ে একে একে তিনি দেড় হাজারেরও বেশি চারা রোপণ করেছেন, যা আজ একেকটি বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
বিষ্ণু হাজরার বৃক্ষরোপণের শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে, যখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৃক্ষ’ কবিতাটি তার জীবনে অন্যরকম আলো জ্বালে। কবিতার লাইনগুলো তাকে বৃক্ষের অপরিসীম উপকারিতার কথা বোঝায়। রাস্তার ধার, ফাঁকা মাঠ কিংবা চা বাগানের আনাচকানাচ- যেখানেই সামান্য খালি জায়গা পান, সেখানেই তিনি জাম, বট, নিম থেকে শুরু করে কাঠগোলাপের মতো নানা ধরনের গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করেন। নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিষ্ণু পত্রিকার হকার ছিলেন। কাজের ফাঁকে সংবাদপত্র পড়তেন, বিশেষত পরিবেশবিষয়ক লেখা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিত। সেখান থেকে সবুজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আরও বাড়ে। এছাড়া কারও জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী বা বিয়ের অনুষ্ঠানে বিষ্ণু এখন উপহার হিসেবে গাছের চারা দেন। তিনি ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে ছবি-ভিডিও পোস্ট করে অন্যদেরও উৎসাহিত করছেন।
গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা (গ্রাউক) কয়েক বছর ধরে তার এই উদ্যোগে চারা কিনে সহযোগিতা করছে। এতে বিষ্ণুর কাজ আরও সহজ হয়েছে। অবাধ বৃক্ষনিধন, বন জঙ্গল উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদী দখল দূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি। একজন সাধারণ চা শ্রমিক হয়েও দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃক্ষরোপণ চালিয়ে যাচ্ছেন বিষ্ণু হাজরা। এ লড়াই অর্থের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তিনি বিশ্বাস করেন প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারলেই মানুষ টিকে থাকবে। তাই সংসারের অভাব অনটন উপেক্ষা করে তিনি আঁকড়ে ধরেছেন সবুজ স্বপ্ন।
সম্প্রতি ভাড়াউড়া চা–বাগানের মন্দিরের পাশে কয়েকজন তরুণকে নিয়ে বিষ্ণু হাজরাকে গর্ত খুঁড়ে জাম, নিম, বট ও কাঠগোলাপের চারা রোপণ করতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ কেন প্রয়োজন
‘কাদের ভাই’য়ের ভেষজ বিপ্লব
শিক্ষার্থীদের হাতে ফলদ-বনজ চারা তুলে দিল ‘প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব’
বিষ্ণু হাজরা বলেন, তখন টিউশনি করে কিছু টাকা রোজগার করতাম। ভেবেছিলাম যদি চারা কিনে লাগাই, বড় হলে বিক্রি করে কিছু অর্থকষ্ট কমানো যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, গাছ শুধু টাকার উৎস নয়, জীবনের জন্য অপরিহার্য। তখন থেকেই নিজের পকেট খরচে চারা লাগানো শুরু করি।
বৃক্ষপ্রেমী বিষ্ণু বলছেন, আমার কার্যক্রম দেখে অনেকে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ চারা কিনে দিচ্ছেন, কেউ সহযোগিতা করছেন। তবে নিজের উপার্জনের একটি বড় অংশ এখনও আমি গাছ লাগানোতেই ব্যয় করি। পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। তবে শুধু লাগানো নয়, সঠিক পরিচর্যাও জরুরি।
ভাড়াউড়া মন্দিরের চকিদার মহা হাজরা বলেন, বিষ্ণু বহু বছর ধরে এখানে–সেখানে গাছ লাগাচ্ছেন। গরম, বৃষ্টি, ঝড় কিছুতেই তিনি থেমে থাকেন না। তার প্রচেষ্টায় এখন আমাদের গ্রাম অনেক সবুজ হয়েছে। আমরা সবাই তার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছি। গাছ শুধু পরিবেশ নয়, আমাদের ধর্মীয় স্থান যেমন মন্দির-মসজিদ রক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। বিষ্ণুর উদ্যোগে মন্দির প্রাঙ্গণেও গাছ রোপণ করেছি।
চা–শ্রমিক সুমন হাজরা বলেন, চা-বাগানে কাজ করে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় আমাদের। কিন্তু বিষ্ণুদা নিজের কষ্টের টাকায় গাছ লাগাচ্ছেন, এটা আমাদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। তার জন্য এখন আশেপাশে অনেক সবুজ হয়েছে।
গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার (গ্রাউক) আঞ্চলিক ম্যানেজার মহাদেব ভুঁইয়া বলেন, ২৮ বছর ধরে আমরা তাকে দেখে আসছি। জন্ম, মৃত্যু বা যে-কোনো অনুষ্ঠানে সে একটি গাছের চারা উপহার দেয়। বিষ্ণু হাজরা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ রক্ষায় নিজ উদ্যোগে গাছ লাগাচ্ছেন। গ্রাউক তার এই উদ্যোগে নিয়মিত চারা সরবরাহ করে আসছে। বিষ্ণুর মতো মানুষ সমাজে যত বাড়বে, পরিবেশ ততটাই সবল হবে।
ওমর ফারুক নাঈম/কেএইচকে/এএসএম
from jagonews24.com | rss Feed https://ift.tt/qyBerz0
via IFTTT